প্রজাতন্ত্র দিবস ও আমরা
রাজেশ চ্যাটার্জী
(এই লেখাটির উপরের অংশ আমার সম্মানীয় শিক্ষক ও শিক্ষিকারা সবাই জানেন মাঝের অংশ থেকে পড়লে আপনি সমৃদ্ধ হবেন এই এই ধারনা আমার ভুলও হতে পারে।)
আজ ২৬ শে জানুয়ারি ২০২০ সাল। এটি ভারতের ৭১তম প্রজাতন্ত্র দিবস বা রিপাবলিক ডে ।
ভারতের তিনটি জাতীয় দিবসের মধ্যে একটি হল প্রজাতন্ত্র দিবস এবং এই সঙ্গে জেনে নেওয়া দরকার অন্যান্য জাতীয় দিবস গুলি হল স্বাধীনতা দিবস এবং গান্ধী জয়ন্তী।
আমরা জানি ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ এ ভারত স্বাধীন হল। কিন্তু দেশের প্রধান হিসেবে তখনও রয়ে গিয়েছিলেন ষষ্ঠ জর্জ এবং লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন ছিলেন এর গভর্ণর জেনারেল। তখনও দেশে কোনো স্থায়ী সংবিধান তৈরি করা যায় নি ; ঔপনিবেশিক ভারত শাসন আইনে সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়েই জোড়াতালি দিয়ে দেশ শাসনের কাজ কোনমতে চলছিল। তাই দেশ শাসনে পরিপূর্ণতা আসছিল না কারণ ভারতের বিভিন্নতা, বহু ভাষা, ধর্ম, জাতি ও সংস্কৃতির দেশ। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ এবং ভারতের একটি নিজস্বতা আনার জন্য ১৯৪৭ খ্রিঃ ২৮শে আগস্ট একটি স্থায়ী সংবিধান রচনার জন্য ড্রাফটিং কমিটি গঠন করা হয় ভীমরাও রামজি আম্বেডকরের নেতৃত্বে । ড.আম্বেডকর ছাড়াও এই কমিটিতে আরও ছয় জন সদস্য সহ ৩০৮ ছিলেন।
এই কমিটি একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করে গণপরিষদে জমা দেয় তারিখ টা ছিল ৪ঠা নভেম্বর ১৯৪৭ । গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগে ২ বছর, ১১ মাস, ১৮ দিন ব্যাপী সময়ে গণপরিষদ এই খসড়া সংবিধান আলোচনার জন্য ১৬৬ বার অধিবেশন ডাকা হয় । এই সমস্ত অধিবেশনে জনসাধারণের প্রবেশের কোন বাধা ছিল না । বহু বিতর্ক ও কিছু সংশোধনের পর ২৪ শে জানুয়ারি ১৯৫০ এ গণপরিষদের ৩০৮ জন চূড়ান্ত সংবিধানের হাতে-লেখা একটি ইংরেজি ও অপরটি হিন্দি নথিতে স্বাক্ষর করেন। এর দু'দিন পর সারা দেশব্যাপী ভারতের নিজস্ব এই সংবিধান কার্যকর হয়। যদিও এই সংবিধানে বৃটেন এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের যথেষ্ঠ ছায়া পাওয়া যায় তবুও এই সংবিধান আমাদের তথা ভারতের একান্ত নিজস্ব সংবিধান।
এই দুটি দেশ ছাড়া আর যে সব দেশের অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় আমাদের এই সংবিধানে সেই দেশগুলি হল আয়ারল্যান্ড ,অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ,ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।আর জার্মানি থেকে পাওয়া গিয়েছে ৩৫৬ ধারার অনুপ্রেরণা।
এখন প্রশ্ন হল ২৬শে জানুয়ারি কেন প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করা হয়?
এর কারণটি হল-
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় গণপরিষদ সংবিধান কার্যকরী হলে ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
কিন্তু ১৯৪৯ সালে ২৬ নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক ভারতের সংবিধান অনুমোদিত হয়। ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে সংবিধান কার্যকর করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ ১৯৩০ সালে ঐ একই দিনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক পূর্ণ স্বরাজের সংকল্প ঘোষিত ও গৃহীত হয়েছিল।এই গুরুত্বের জন্য ২৬শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস
অপরদিকে ২৬ শে নভেম্বর পালন করা হয় সংবিধান দিবস হিসাবে।
এবার আসা যাক সংবিধানের প্রস্তাবনাটি সম্পর্কে ।
সংবিধানের প্রস্তাবনাটি ছিল এই রূপ-
“ আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম , গণতান্ত্রিক ,সাধারণতন্ত্ররূপে গড়িয়া তুলিতে এবং উহার সকল নাগরিক যাহাতে:
সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচার ;
চিন্তার, অভিব্যক্তির, বিশ্বাসের, ধর্মের ও উপাসনার স্বাধীনতা ;
প্রতিষ্ঠা ও সুযোগের সমতা
নিশ্চিতভাবে লাভ করেন;
এবং তাঁহাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-মর্যাদা ও জাতীয় ঐক্য ও সংহতির আশ্বাসক বর্ধিত হয়।
তজ্জন্য সত্যনিষ্ঠার সহিত সংকল্প করিয়া আমাদের সংবিধান সভায় অদ্য, ২৬ নভেম্বর, ১৯৪৯ তারিখে, এতদ্দ্বারা
এই সংবিধান গ্রহণ, বিধিবদ্ধ এবং আমাদিগকে অর্পণ করিতেছি।”
পরবর্তীকালে ১৯৭৬ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনাটি ৪২ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আবার পরিবর্তন করা হয় এবং এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় সমাজতান্ত্রিক,ধর্মনিরপেক্ষ ও ভ্রাতৃভাব এই কথাটি।
সাধারণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে জাতীয় রাজধানী নতুন দিল্লীতে কুচকাওয়াজ হয় রাষ্ট্রপতির আবাসস্থল রাষ্ট্রপতি ভবনের নিকটবর্তী রাইসিনা হিল থেকে রাজপথ বরাবর ইন্ডিয়া গেট ছাড়িয়ে। কুচকাওয়াজ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে রাষ্ট্রপতি রাজপথের একপ্রান্তে অবস্থিত ইন্ডিয়া গেটে শহিদ সৈন্যদের উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মারক অমর জওয়ান জ্যোতি-তে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রধান অতিথি ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেও প্রতিবছর এক বা একের বেশি অতিথি রাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ করা হয়।
অতিথি রাষ্ট্র কে হবে তা নির্ধারিত হয় কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে।
ভুটান ও ফ্রান্স সবচেয়ে বেশি বার (চার বার) আমন্ত্রিত হয়েছে, আর তাদের পরেই আছে মরিশাস , সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমান রাশিয়া এবং ব্রাজিল: শেষোক্ত তিন দেশই আমন্ত্রিত হয়েছে তিন বার করে।
১৯৫০ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রথম ও প্রধান অতিথি ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকণ্য এবং 2000 সালে ৫০তম বর্ষে প্রধান অতিথি ছিলেন নাইজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ওলুসেগুন ওবাসাঞ্জো ।
এমনকি ২০১৫ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন।
এছাড়া ২০১৮ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে সবথেকে বেশি রাষ্ট্রপ্রধানরা এসেছিলেন ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে এখানে আশিয়ান দেশগুলির অন্তর্গত রাষ্ট্রপ্রধানরা ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে এসেছিলেন।
২০২০ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রধান অতিথি হয়ে এসেছেন ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি জাহির বল সোনারো।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো মোট তিনবার প্রজাতন্ত্র দিবসে কোন রাষ্ট্রপ্রধান কে আমন্ত্রণ করা হয়নি । সাল গুলি হল ১৯৫২, ১৯৫3 এবং ১৯৬৬ ।
এবার আমরা জানবো প্রজাতন্ত্র দিবসে কি কি অনুষ্ঠান পালিত হয়।
প্রজাতন্ত্র দিবসে অনুষ্ঠান সূচনা হয় জাতীয় সংগীত দিয়ে এবং এর সমাপ্তি ঘটে সারে জাহা সে আচ্ছা এই গানটির মাধ্যমে।
প্রজাতন্ত্র দিবসে তিন বাহিনী যথা নৌবাহিনী , বায়ুবাহিনী ও স্থলবাহিনী প্রধানরা উপস্থিত থাকেন এবং এই তিন বাহিনীর সৈনিকরা তাদের বিভিন্ন কার্যকলাপ প্রদর্শন করেন।
এছাড়া ভারতের প্রায় সমস্ত রাজ্য এই প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে তাদের ট্যাবলো সহ অংশগ্রহণ করেন।
সেনাবাহিনীর বীর সৈনিকদের উৎকর্ষতা বিচার করার জন্য এই দিনে পরমবীর চক্র প্রদান করা হয়।
এই দিনে সন্ধ্যায় বিশেষ অনুষ্ঠানে পদ্মশ্রী পদ্মবিভূষণ ও পদ্মভূষণ পুরস্কার দেয়া হয় সাহিত্য চিকিৎসক অভিনেত্রী নাট্যকর্মী রাজনীতিবিদ বিজ্ঞানী এবং খেলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে।
এবার আমরা জানবো ২৬ শে জানুয়ারির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-
আমরা সবাই জানি প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান রাজপথে হয় কিন্তু ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানটা রাজপথে হতো না। অনুষ্ঠান চলত অরবিন্দ স্টেডিয়ামে যেটা বর্তমান ন্যাশনাল স্টেডিয়াম নামে পরিচিত এছাড়া কিংস্ওয়ে, লালকেল্লা, রামলীলা ময়দানে অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৫৫সাল থেকেই রাজপথেই এই প্যারেড অনুষ্ঠান হয় ওই সময় ওই রাস্তাটি কে বলা হতো কিংস্ ওয়ে ।
২৬ শে জানুয়ারির এই অনুষ্ঠানটি রাষ্ট্রপতির আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতে থাকে রাষ্ট্রপতির ঘোড়সাওয়ার ও দেহরক্ষীদের দ্বারা জাতীয় পতাকার সম্মান দেয়া হয়। ওই সময় জাতীয় সংগীত বাজানো হয় এবং ২১ টা বন্দুকের গোলা ছোড়া হয়।
প্রজাতন্ত্র দিবস অনুষ্ঠান আসলে তিন দিনের দীর্ঘ অনুষ্ঠান যেটি শেষ হয় ২৯ শে জানুয়ারি বীটিং রিট্রীট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।ভারতের সামরিক বাহিনীর তিন প্রধান শাখা ভারতীয় স্থলসেনা, ভারতীয় নৌবাহিনী এবং ভারতীয় বায়ুসেনা এই রিট্রীটে অংশ নেয়। রাজপথের প্রান্তে ভারতের কেন্দ্রীয় সচিবালয় ও রাষ্ট্রপতি ভবনের নর্থ ব্লক ও সাউথ ব্লক ভবন দু'টির মধ্যবর্তী রাইসিনা হিল ও বিজয় চকে এই অনুষ্ঠানটি হয়।
প্যারেডে যোগদানকারী প্রতিটা দল রাত্রি দুটো থেকেই তৈরি হয়ে যান এবং ভোর তিনটের সময় তারা রাজপথে চলে আসেন। কিন্তু এই প্যারাডে অনুশীলন আগের বছর জুলাই থেকেই শুরু হয়ে যায় এবং আগস্ট মাস পর্যন্ত তারা তাদের নিজস্ব কেন্দ্রে এই অনুশীলন সম্পন্ন করেন। ডিসেম্বর মাসে এরা সবাই দিল্লিতে চলে আসেন। কিন্তু ২৬ শে জানুয়ারি এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার আগে তারা মোট ৬০০ ঘন্টা কঠিন অনুশীলন করেন।
প্যারেডে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি গাড়ি ,যন্ত্র এবং অস্ত্রশস্ত্র অন্তত দশবার করে পরীক্ষা করা হয় ।যাতে ক্ষতিকর কোনো অস্ত্র বা গোলা না থাকে।
২৬শে জানুয়ারি অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য প্রতিটি দলের যে অনুশীলন হয় সেই অনুশীলনের সময় প্রত্যেকটা দল অন্তত ১২ কিলোমিটার দূরত্ব বজায় রাখে এবং ২৬ শে জানুয়ারি দূরত্ব কমে হয় ৯ ঘণ্টা এবং এদের যাত্রার গতিবেগ থাকে ঘন্টায় পাঁচ ঘন্টা ,যাতে সমস্ত দর্শনার্থীরা এই অনুষ্ঠান ভালো ভাবে উপভোগ করতে পারে ।
সমস্ত প্যারেডের যাত্রাপথে বিভিন্ন বিচারক মন্ডলী বসে থাকেন তারা ২০০ নম্বরের মধ্যে প্রত্যেক দলকে নম্বর দেন এবং সবশেষে সেরা দল কে পুরস্কৃত করা হয়।
প্যারেডের সবথেকে দৃষ্টিনন্দন অনুষ্ঠানটি হল বায়ুসেনা দ্বারা বিভিন্ন জেট প্লেনের উড়ান পদ্ধতি এবং এটির দায়িত্ব থাকেন পশ্চিমী বায়ুসেনার কমান্ডের কাছে। এখানে মোট ৪১ টি বিমান যোগদান করে।
প্রত্যেক প্রজাতন্ত্র দিবসে নিশ্চিত ভাবে Abide with me গানটি গাওয়া হয় কারণ এটি মহাত্মা গান্ধীর খুবই পছন্দের গান ছিল।
প্যারেডের যোগদানকারী সৈনিকরা ভারতে তৈরি ইনসাস রাইফেল ব্যবহার করেন।
আবার বিশেষ সুরক্ষা জওয়ানরা ইসরাইলের তৈরি টেগোর রাইফেল ব্যবহার করেন।
এই হল ২৬ শে জানুয়ারি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আমার একটি লেখা। তবে ঠিক লেখা নয় তথ্য জোগাড় করা ।
প্রতিবছর ২৬ শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করলেও এর মূল ভাবনা গুলি আমরা কখনো মনে রাখি না অথবা মনে থাকলেও এর প্রয়োগ গুলো আমরা সঠিক ভাবে করি না অথবা আমরা নিজেরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করি না। যা লেখা থাকে বছরের পর বছর ধরে সংবিধানের পাতায় এবং আমাদের বইয়ের পাতায় অথবা বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের বক্তব্যের মাঝে এবং আমাদের মনে বাস্তবে এর প্রয়োগ খুবই কম।
উপরে যা আমি লিখেছি তা ইন্টারনেট ও বিভিন্ন বই থেকে সংগ্রহ করা তথ্যাবলী থেকে সংগ্রহীত । এই তথ্যাবলীগুলি যদি কোন ভুল থাকে আমাকে মার্জনা করবেন। এবং কমেন্টসের মাধ্যমে সঠিকটা লিখবেন আমি সংশোধন করার চেষ্টা করবো। কাউকে বিভ্রান্ত করা অথবা ভুল তথ্য পরিবেশন করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
সবাই ভাল থাকবেন এবং অন্যকে ভাল রাখবেন ।
জয় হিন্দ । বন্দেমাতারাম ।